মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দারিদ্র্য জয় করে ছোটন এখন ম্যাজিস্ট্রেট

  • Reporter Name
  • Update Time : ০১:১০:৫০ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৯ মে ২০২৫
  • ৩৮ Time View

জন্ম কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার হোসনাবাদে। শৈশব থেকেই তীব্র আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি। আমার বাবা ছিলেন একজন দিনমজুর, অন্যের জমিতে কাজ করতেন। সংসার চালাতেই তিনি হিমশিম খেতেন।

তাই পড়াশোনার খরচ জোগাতে আমিও বাবার সঙ্গে অন্যের জমিতে কাজ করতাম। পড়াশোনা, চাকরির প্রস্তুতি—সবই করেছি নিজের আগ্রহে।নবম শ্রেণিতে ওঠার পর স্কুল শিক্ষকরা পরামর্শ দেন বিজ্ঞান বিভাগে পড়তে। কিন্তু বিজ্ঞানে ভালো করতে প্রাইভেট পড়তে হয়! চিন্তায় পড়ে গেলাম।চাপ কমাতে অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে উচ্চতর গণিত না নিয়ে কৃষি নিই।

বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল না। রাতে হারিকেন জ্বালিয়ে পড়লে খরচ হয় বলে দিনে পড়তে হতো। এসএসসিতে গোল্ডেন এ-প্লাস পেলাম।ভর্তি হই কুমিল্লা সরকারি কলেজে। দূরে থেকে পড়াশোনার খরচের সামর্থ্য না থাকায় দুই মাস পর ভর্তি বাতিল করে গ্রামে চলে আসি।

গ্রামের একটি কলেজে ভর্তি হই। ২০১৬ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিই। কোচিং করতে পারিনি।এক কলেজবন্ধু আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রস্তুতির জন্য ৩টি সহায়ক বই উপহার দেয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বি’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা দিই। ভূমি ব্যবস্থাপনা ও আইন বিষয়ে ১০২তম হই। পরে মাইগ্রেশন করে আইন বিভাগে ভর্তি হই। খরচ জোগাতাম টিউশনি করে। টিউশনি করলে বেসিক অনেক বিষয় চর্চায় থাকে, যা চাকরির প্রস্তুতিতেও কাজে আসে।২০২০ সালে হঠাৎ বাবা মারা যান। মনে মনে ভাবলাম, পরিবারের জন্য হলেও ক্যারিয়ারে সফল হতে হবে। আমি যখন ৪র্থ বর্ষে পড়ি তখন থেকেই মূলত চাকরির প্রস্তুতি শুরু করি। লক্ষ্য নির্ধারণ করলাম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্য হব! করোনার সময় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করতাম। আমার মেন্টর হিসেবে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র এক ভাই। শুরুটা কিভাবে করতে হবে, কোন কোন বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দিতে হবে, সেই বিষয়গুলোতে তিনি আমাকে যথেষ্ট সহায়তা করেছেন।

শুরু থেকেই প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষার জন্য একসঙ্গে প্রস্তুতি নিয়েছি। আমার কোনো নোট করার অভ্যাস ছিল না। তাই প্রতিটি বিষয়ের জন্য আলাদা আলাদা বই সংগ্রহ করে বিস্তারিত বুঝে পড়তাম। বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ লাইনগুলো দাগিয়ে টুকে রাখতাম।

যে বিষয়গুলোতে নম্বর তোলা সহজ, সেগুলোর ওপরই আমি বাড়তি জোর দিয়েছি। গণিত ও বিজ্ঞানে উত্তর ঠিকঠাক হলে বেশি নম্বর তোলা যায়। তাই বিষয়গুলোকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। এ ছাড়া বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হওয়ায় এই দুই বিষয়ের ওপর ভালোই দখল ছিল। তা ছাড়া প্রস্তুতির সময় মুসলিম আইন ও বিশেষ আইনের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। কারণ এই বিষয়গুলোতে ‘সমস্যা’সংক্রান্ত প্রশ্ন বেশি থাকে। কিন্তু সঠিক উত্তর দিতে পারলে গণিতের মতো পুরো নম্বর তোলা যায়।

২০২০ সালে অনার্স চূড়ান্ত পরীক্ষা হওয়ার কথা থাকলেও করোনার কারণে শেষ হয় এক বছর পর। অনার্স শেষে প্রথমবারের মতো ১৫তম বিজেএস পরীক্ষায় অংশ নিই। সেই পরীক্ষায় আমি প্রিলিমিনারি থেকেই বাদ পড়ে যাই। ভালো প্রস্তুতি থাকার পরও প্রিলিমিনারিতে না টিকে কিছুটা হতাশ হয়ে পড়ি। কিন্তু হাল না ছেড়ে ১৬তম বিজেএস পরীক্ষায় অংশ নিই। এই বিজেএসে প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও ভাইভায় পাস করতে পারিনি। তারপর মানসিকভাবে তৈরি হয়েও আবারও প্রস্তুতি নিই। অবশেষে ১৭তম বিজেএস পরীক্ষায় অংশ নিই। সব ধাপে ভালো করে সহকারী জজ/জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হই।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Farhan Shekh

জনপ্রিয়

দারিদ্র্য জয় করে ছোটন এখন ম্যাজিস্ট্রেট

Update Time : ০১:১০:৫০ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৯ মে ২০২৫

জন্ম কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার হোসনাবাদে। শৈশব থেকেই তীব্র আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি। আমার বাবা ছিলেন একজন দিনমজুর, অন্যের জমিতে কাজ করতেন। সংসার চালাতেই তিনি হিমশিম খেতেন।

তাই পড়াশোনার খরচ জোগাতে আমিও বাবার সঙ্গে অন্যের জমিতে কাজ করতাম। পড়াশোনা, চাকরির প্রস্তুতি—সবই করেছি নিজের আগ্রহে।নবম শ্রেণিতে ওঠার পর স্কুল শিক্ষকরা পরামর্শ দেন বিজ্ঞান বিভাগে পড়তে। কিন্তু বিজ্ঞানে ভালো করতে প্রাইভেট পড়তে হয়! চিন্তায় পড়ে গেলাম।চাপ কমাতে অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে উচ্চতর গণিত না নিয়ে কৃষি নিই।

বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল না। রাতে হারিকেন জ্বালিয়ে পড়লে খরচ হয় বলে দিনে পড়তে হতো। এসএসসিতে গোল্ডেন এ-প্লাস পেলাম।ভর্তি হই কুমিল্লা সরকারি কলেজে। দূরে থেকে পড়াশোনার খরচের সামর্থ্য না থাকায় দুই মাস পর ভর্তি বাতিল করে গ্রামে চলে আসি।

গ্রামের একটি কলেজে ভর্তি হই। ২০১৬ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিই। কোচিং করতে পারিনি।এক কলেজবন্ধু আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রস্তুতির জন্য ৩টি সহায়ক বই উপহার দেয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বি’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা দিই। ভূমি ব্যবস্থাপনা ও আইন বিষয়ে ১০২তম হই। পরে মাইগ্রেশন করে আইন বিভাগে ভর্তি হই। খরচ জোগাতাম টিউশনি করে। টিউশনি করলে বেসিক অনেক বিষয় চর্চায় থাকে, যা চাকরির প্রস্তুতিতেও কাজে আসে।২০২০ সালে হঠাৎ বাবা মারা যান। মনে মনে ভাবলাম, পরিবারের জন্য হলেও ক্যারিয়ারে সফল হতে হবে। আমি যখন ৪র্থ বর্ষে পড়ি তখন থেকেই মূলত চাকরির প্রস্তুতি শুরু করি। লক্ষ্য নির্ধারণ করলাম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্য হব! করোনার সময় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করতাম। আমার মেন্টর হিসেবে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র এক ভাই। শুরুটা কিভাবে করতে হবে, কোন কোন বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দিতে হবে, সেই বিষয়গুলোতে তিনি আমাকে যথেষ্ট সহায়তা করেছেন।

শুরু থেকেই প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষার জন্য একসঙ্গে প্রস্তুতি নিয়েছি। আমার কোনো নোট করার অভ্যাস ছিল না। তাই প্রতিটি বিষয়ের জন্য আলাদা আলাদা বই সংগ্রহ করে বিস্তারিত বুঝে পড়তাম। বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ লাইনগুলো দাগিয়ে টুকে রাখতাম।

যে বিষয়গুলোতে নম্বর তোলা সহজ, সেগুলোর ওপরই আমি বাড়তি জোর দিয়েছি। গণিত ও বিজ্ঞানে উত্তর ঠিকঠাক হলে বেশি নম্বর তোলা যায়। তাই বিষয়গুলোকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। এ ছাড়া বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হওয়ায় এই দুই বিষয়ের ওপর ভালোই দখল ছিল। তা ছাড়া প্রস্তুতির সময় মুসলিম আইন ও বিশেষ আইনের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। কারণ এই বিষয়গুলোতে ‘সমস্যা’সংক্রান্ত প্রশ্ন বেশি থাকে। কিন্তু সঠিক উত্তর দিতে পারলে গণিতের মতো পুরো নম্বর তোলা যায়।

২০২০ সালে অনার্স চূড়ান্ত পরীক্ষা হওয়ার কথা থাকলেও করোনার কারণে শেষ হয় এক বছর পর। অনার্স শেষে প্রথমবারের মতো ১৫তম বিজেএস পরীক্ষায় অংশ নিই। সেই পরীক্ষায় আমি প্রিলিমিনারি থেকেই বাদ পড়ে যাই। ভালো প্রস্তুতি থাকার পরও প্রিলিমিনারিতে না টিকে কিছুটা হতাশ হয়ে পড়ি। কিন্তু হাল না ছেড়ে ১৬তম বিজেএস পরীক্ষায় অংশ নিই। এই বিজেএসে প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও ভাইভায় পাস করতে পারিনি। তারপর মানসিকভাবে তৈরি হয়েও আবারও প্রস্তুতি নিই। অবশেষে ১৭তম বিজেএস পরীক্ষায় অংশ নিই। সব ধাপে ভালো করে সহকারী জজ/জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হই।