
মুসলিমা খাতুন: গৃহিণী থেকে স্বাবলম্বী সফল মাছচাষি
খুলনার কয়রা উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের মাদারবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা মুসলিমা খাতুন (৩৫) একসময় সংসারের অভাব-অনটনে জর্জরিত ছিলেন। পরিবার চালাতে তাঁকে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে হতো। স্বামী ছিলেন প্রান্তিক জেলে এবং সনাতনী পদ্ধতির ক্ষুদ্র মাছচাষি। স্বামীর অনিয়মিত আয় আর সংসারের চাহিদা মেটানো ছিল অত্যন্ত কঠিন। স্বামী বাড়িতে না থাকলে ঘের দেখাশোনার দায়িত্বও পড়ত মুসলিমার ওপর, কিন্তু প্রযুক্তিগত জ্ঞান না থাকায় মাছের উৎপাদন খুবই কম হতো।
পরিবর্তন আসে যখন তিনি সাতক্ষীরা উন্নয়ন সংস্থা (সাস) বাস্তবায়িত এবং পিকেএসএফ, ইফাদ ও ড্যানিডার সহযোগিতায় পরিচালিত আরএমটিপি প্রকল্পের ‘নিরাপদ মৎস্য ও মৎস্য পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ’ উপ-প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত হন। প্রকল্পের আওতায় তিনি আধা-নিবিড় মাছচাষ, ঘের ব্যবস্থাপনা, সঠিক খাদ্য প্রয়োগ, পানি-মাটি পরীক্ষা, রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
প্রশিক্ষণ শেষ করে মুসলিমা খাতুন তাঁর ৬৬ শতকের ঘেরে রুই, কাতলা, গলদা ও বাগদা চিংড়ি চাষ শুরু করেন। প্রকল্পের মৎস্য সেবা ও পরামর্শ কেন্দ্রের সহায়তায় তিনি ঘেরে এ্যারেটর স্থাপন, ব্লু নেট ব্যবহার, নিয়মিত চুন প্রয়োগ এবং পানি-মাটির পরীক্ষার সুবিধা নেন। এতে ঘেরে রোগবালাই কমে যায় এবং উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।
মোট খরচ: প্রায় ১,১৭,০০০ টাকা মোট বিক্রি: প্রায় ৩,৮০,০০০ টাকা
প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় তাঁর আয় ও লাভ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
মুসলিমা খাতুন বলেন, “আধুনিক প্রযুক্তি, ব্লু নেট ও এ্যারেটর ব্যবহার করার ফলেই আমার ঘেরে উৎপাদন বেড়েছে। এখন আমি শুধু নিজের পরিবারই স্বাবলম্বী করতে পেরেছি তা নয়—আমার সাফল্য দেখে আশপাশের মাছচাষিরাও উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। সামনে আরও বড় পরিসরে ঘের বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে।”
স্বল্পশিক্ষিত এক গৃহিণী থেকে সফল নারী উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা মুসলিমা এখন স্থানীয়ভাবে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
সাতক্ষীরা উন্নয়ন সংস্থা (সাস)-এর নির্বাহী পরিচালক শেখ ইমান আলী বলেন, “মুসলিমার গল্প প্রমাণ করে সুযোগ, দিকনির্দেশনা আর পরিশ্রম একসাথে কাজ করলে পরিবর্তন অনিবার্য। তিনি শূন্য থেকে শুরু করেছিলেন। আজ আধুনিক ঘের ব্যবস্থাপনা ও নিয়মিত মনিটরিংয়ের মাধ্যমে তিনি দৃষ্টান্তমূলক সাফল্য দেখাচ্ছেন।”
মহারাজপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, “মুসলিমা খাতুনের সাফল্য আমাদের ইউনিয়নের জন্য গর্বের বিষয়। যিনি একসময় সংসারের টানাপোড়েন সামলাতে হিমশিম খেতেন, আজ আধুনিক প্রযুক্তিতে ঘেরে উৎপাদন বাড়াচ্ছেন—এটা উপকূলীয় এলাকার বাস্তব পরিবর্তনের সাক্ষ্য।”
গৃহিণী থেকে সফল মাছচাষি হয়ে ওঠার মুসলিমার এই যাত্রা প্রমাণ করে দক্ষতা, প্রশিক্ষণ এবং অবিচল পরিশ্রম—এই তিনটি একসাথে থাকলে উন্নতির পথ কখনো বন্ধ হয় না।